আজকাল আবহাওয়া স্বর্গের মত সুন্দর। তাই ব্যাক প্যাকটা নিয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়লাম প্রকৃতির সাথে মিলিত হতে। সোনালি রোদে গাছের পাতা গুল চিক চিক করছিল। মনটা আমার ভীষণ আনন্দে হেসে উঠলো।
এখন এখানে বসন্ত কাল। বিভিন্ন রঙের ফুল ফুটেছে। গত দুমাস আগে যে গাছটা মরা ডাল নিয়ে ছিল, আজ ওটা গাঢ় হলুদ, অথবা লাল, বেগুনি আর কত কি রঙের ফুলে ছেয়ে গেছে। ।
এই সিজনে আমি হাটতে ভালবাসি। আকশমনি, চেরি এবং আরো অনেক বন্য ফুলগুলোর সাথে আমার অনেক কথা হয়। সবুজ ঘাসের সোঁদা গন্ধ আমার বড্ড ভাল লাগে। হেটে যেতে যেতে কতো কি খুঁটি নাটি দেখি। আমার মনটা অসম্ভব ভাল লাগায় ভরিয়ে দেয়। এসব ই আমার সৃষ্টিকর্তার সাথে আমাকে একাত্ম করে দেয়। ফুলের পাপড়ি গুলো সারা পথ পুস্পময় করে রেখেছে। তারপর ফুলের পাপড়ি গুলো যখন গাছ থেকে উড়ে উড়ে আমার গায়ে এসে পড়ে আমি ভাবতে শুরু করি আল্লাহ্র রহমত আমাকে যেন ছুঁয়ে দিচ্ছে।
কি মিষ্টি আমাদের এই পৃথিবী ভাবছিলাম এবং এগুচ্ছিলাম। এক পর্যায়ে পার্কের বেঞ্চে বসলাম। পাশের বেঞ্চের থেকে একটা মেয়ে উঠে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমি ভাল করে চিন্তে পারলাম না। পরে ও বলল কয়েক বছর আগে আমি ওকে স্কুলে যেতে বলেছিলাম এবং কিছু উপদেশ দিয়েছিলাম । ও ওগুলো অনুসরন করেছে। ও স্কুলে পড়ে। ও এখন জব করে এবং পড়াশুনা করে। শ্বশুর বাড়ির সংসারের খরচ ও শেয়ার করে। তাই সংসারে শান্তি ফিরে এসেছে। ওর বর আমাকে অনেক কৃতজ্ঞতা জানাল।
আসলে সত্যি বলতে কি আমি তাকে চিনতে পারিনি। আমি স্মৃতির পাতা ঘাটতে লাগলাম এবং মনে পড়ে গেলো কয়েক বছর আগে এমন এক সুন্দর দিনের ঘটনা। আমি প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে পার্কের বেঞ্চে বসতে নিলাম। পাশের বেঞ্চে দেখলাম তিনজন বাঙ্গালি বসে আছে। এর মধ্যে একজন অঝোরে কেঁদে যাচ্ছে এবং তার জীবনের কষ্ট গুলো শেয়ার করছে অন্য দুজন মেয়ের সাথে। আমি ওরা ওদের ব্যক্তিগত কথা বলছে বলে উঠে দাড়ালাম অন্য বেঞ্চে যাবার জন্য। হঠাৎ ওদের একজ্ন আমাকে ডাকল আমি
ফিরে তাকালাম ও আমারিকার বাংলাদেশ এমব্যাসির একজন কন্সুলারের মেয়ে। টুয়েলবথ গ্রেড এ পড়ে। আমাকে বলে একটু আসবেন এখানে ? গেলাম।
আমি জিজ্ঞেশ করলাম উনি কাদছেন কেন? তখন ওই মেয়ে আমাকে বললো ওর সমস্যা। মেয়েটা এখানে নতুন এসেছে। তার বর দুটো জব করে। মেয়েটা সারাদিন বাসায় থাকে। শশুর শাশুড়ির সেবা, ননদ দেবরের আবদার। রান্না বান্না এসব করে। এতে মেয়েটির কোন সমস্যা নেই।
মেয়েটা শ্বশুর, শাশুড়ি এবং ননদের উৎপীড়নে জরজরিত। যন্ত্রণা গুলো মানসিক ভাবে ওকে ভীষণ অসহায় করে তুলেছে। বাংলাদেশে মেয়েটা অনেক আদরে বড় হয়েছে। অনেক প্রাচুর্যের মধ্যে বেড়ে উঠেছে।
এখন ওকে দিয়ে সারাদিন হাড় ভাঙ্গা খাটুনি খাটায়, বরের সাথে কথাটা পর্যন্ত বলতে দেয়না। আমি মেয়েটার চোখের জল মুছিয়ে দিলাম ওকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। মেয়েটা বাচ্চার মত আমাকে ধরে রাখল। আমি ওকে ছাড়াতে গেলাম ও বলল আমি কি তোমাকে আরেকটু ধরে রাখতে পারি? । আমি বুঝলুম ও হীল হচ্ছে। আমি ওকে সময় দিলাম আলিঙ্গন নেবার জন্য, এক পর্যায় আমি অনুভব করলাম ও নিজেকে নিরাপদ ভাবতে শুরু করেছে। ওর মানসিক চাপ ও বিষন্নতাও কমে গেল। ওর মুখে অসাধারণ সুন্দর হাসি ফুটল। সুখ এবং দুঃখ মিলানো অপরুপ হাসি আমাকে প্রশান্তি দিলো। আমি বললাম তুমি মন খারাপ একদম করবেনা, আসলে তুমি
আপনজনদের ফেলে এসেছ তো তাই এমন মন খারাপ হচ্ছে। তুমি স্কুলে ভর্তি হও। পার্ট টাইম জব করো। তোমাকে সাবলম্বি হতে হবে। তোমার নিজেকে তৈরি করতে হবে. তুমি দেখে নিও সব ঠিক হয়ে যাবে। আর ঐ কন্সুলারের মেয়েকে বললাম তুমি ওর বরকে বলবে ওকে ইস্কুলে ভরতি করে দিতে। স্কুলে গেলে অন্য মানুষের সাথে মিশলে ওর মন ভাল থাকবে। ভাবিনি যে ও আমার কথা ফলো করবে। এটা দেখে ভাল লাগলো।
ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পার্কিং লটের দিকে যাচ্ছিলাম এবং ভাবছিলাম
যে মানুষ এত নির্মম হয় আমার বোধগম্য নয়। একটা মেয়ে যখন বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ি যায় তখন মেয়েটা একটা অপরিচিত মানুষের কাছে অসহায় থাকে। শ্বশুর বাড়ির মানুষদের উচিৎ মেয়েটার সাথে সুন্দর আচরণ করে ওকে আপন করে নেয়া। এতে করে মেয়েটি ধীরে ধীরে বরের বাড়ির মানুষদের সুখে দুঃখে সামিল হতে শুরু করবে। এক পর্যায় ও বাড়িটাকে তার নিজের বাড়ি বলে ভাবতে শুরু করবে। আর যদি এই উৎপীড়ন অনবরত চলতে থাকে, মেয়েটি শ্বশুর বাড়িকে বদ্ধ খাঁচা বলে ভাববে এবং বরের বাড়ির মানুষদের সুখে দুঃখে সামিল হতে পারবেনা। আমাদের উচিৎ মনকে প্রসারিত করা। ঘরের বউদের নিজের মেয়ে হিসেবে ভালবাসা কারন আমাদের ই মেয়ে অথবা ভাগ্নি অন্যের ঘরের বউ হয়ে গেলে যদি তারা এমন ব্যবহার করে , তখন আপনার কি অনুভুতি হবে? ভাবুন না ? উত্তরটা কিন্তু আপনার জানা আছে। #CR1076